সর্বশেষ:

সুন্দরবনে ২০ বনদস্যু বাহিনীর দাপট, বনদস্যুদের তৎপরতায় আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন,জেলে, বনজীবীদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে

Facebook
Twitter
LinkedIn

আবু হানিফ, বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ

সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণার ৬ বছরের মাথায় আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। নতুন করে বনদস্যুদের তৎপরতায় অশান্ত হয়ে উঠেছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। পুরনো আত্মসমর্পণকারী এবং নতুন ভাবে সংগঠিত দল মিলে অন্তত ২০টি বনদস্যু বাহিনী এখন সক্রিয়। এসব বনদস্যু দল জেলেদের অপহরণ করে আদায় করছে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এতে জেলে, বনজীবীদের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। ফলে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর উপকূলজুড়ে বনদস্যু ভয়ে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। গোটা সুন্দরবন বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় সামপ্রতিক সময়ে এদের আধিপত্য বেশি।
সুন্দরবনে ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর থেকে সুন্দরবনে ফিরে আসে শান্তির সুবাতাস। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে সেই দৃশ্যপট। ফের বনদস্যুদের রাজত্বে পরিণত হয় সুন্দরবন। শান্ত সুন্দবনের সেই নদ-নদী, খাল গত এক বছরে আবার ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দস্যুদের অস্ত্রের ঝংকারে দীর্ঘদিন শান্ত থাকা সুন্দরবন এখন পরিণত হয়েছে আতঙ্কের বনে। এ অবস্থায় বনে যেতে ভয় পাচ্ছেন জেলেরা। এর ফলে অর্থনীতিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষনা করে সরকার। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান আত্মসর্ম্পণকারী দস্যুরা। শান্তি ফিরে আসে গোটা সুন্দরবনে।২০২৪ সালের ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর তারা সরকারি সহায়তা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। যারা এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিলেন তাদেরকেও এখন চাঁদা দিচ্ছে হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের দস্যু নামের সেই পুরনো অপবাদ। সাবেক দস্যু নাম শুনলেই ভয়ে আর কেউ তাদের কাজে নেয় না। এমনকি নিজ এলাকার বাইরে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেখানেও তাদের সম্পৃক্ততা দেখিয়ে মিথ্যা মামলা এবং প্রশাসনিক হয়রানি করা হয়। যে কারণে অনেকটা ক্ষোভ ও হতাশায় অস্ত্র হাতে তুলে আবার সেই অপরাধ জগতে ফিরেছেন অনেকেই।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন আত্মসমর্পণ করা জাহাঙ্গীর বাহিনীর প্রধান জাহাঙ্গীর শেখ, দাদা ভাই বাহিনী প্রধান জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন এবং মানজুর বাহিনীর প্রধান মানজুর সরদার।
তারা বলেন, দস্যুতা তাদের ভালো লাগে না। বাধ্য হয়ে এসেছেন। তবে সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পেলে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন তারা।বনবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলে ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, বনদস্যুরা বিভিন্ন নামে দল (বাহিনী) গঠন করে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্বের আত্মসমর্পণকারীসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত দাগি আসামীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাহিনীগুলো।
এসব বাহিনীর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মানজুর বাহিনী এবং দাদাভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্যসংখ্যায় বেশি এবং দুর্ধর্ষ। এই তিন বাহিনী পূর্বে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবি জীবনে ফিরে গিয়েছিল। এছাড়া করিম শরীফ বাহিনী, আসাবুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাই ভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনারুল বহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যেও পুরনো অনেকেই নতুন বাহিনী নাম দিয়ে করছেন দস্যুবৃত্তি। এর বাইরেও ছোট ছোট আরো ৭-৮টি দস্যুবাহিনী রয়েছে বলেও জানা গেছে। এদের একেক বাহিনীতে ১৫-২০ জন থেকে ৪০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। এসব বাহিনীর প্রত্যেকের হাতে রয়েছে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। এরা গহীন বনে আস্তানা গড়ে জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছে।

এক বছর ধরে অস্বাভাবিক বেড়েছে দস্যুদের উৎপাত। এপর্যন্ত কমপক্ষে তিন শতাধিক জেলে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গত এক মাসেই (১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে) শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে দস্যুরা। এদের মধ্যে অনেকেই গোপনে মোবাইল বিকাশ এবং দস্যুদের সোর্সের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। এখনো শরণখোলার ১৫ থেকে ২০ জন জেলে কয়েকটি বাহিনীর কাছে জিম্মি রয়েছেন বলে মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে দস্যুদের পদচারণা বেশি। বনের মরাভোলা, আলীবান্দা, ধনচেবাড়িয়া, দুধমুখী, শ্যালা, নারকেলবাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, টিয়ারচর, পশুর, আন্দারমানিক, শিবসাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাহিনীগুলোর অবস্থান বলে জানা গেছে।

আগে যে সকল দস্যুরা সুন্দরবনে দস্যুবৃত্তি করতো তাদের প্রত্যেকেরই ছিল এক বা একাধিক গডফাদার বা নিয়ন্ত্রক। এসব গডফাদাররা ছিলেন বনসংগ্ন এলাকার প্রভাবশালী। সেই নিয়ন্ত্রকরাই অস্ত্র, রসদ যোগান, মুক্তিপণের টাকা গ্রহন এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কাজ করতেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সময়েও বনসংগ্ন এলাকার কিছু প্রবাভশালী ব্যক্তি দস্যুদের গডফাদার, মধ্যস্ততাকারী এবং সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা গোপানে জিম্মি জেলেদের পরিবার ও তাদের মহাজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা (চাঁদা) আদায় করে দস্যু বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন বাহিনীর সংকেত সম্বলিত টোকেন দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এই টোকেন জেলের নৌকায় থাকলে নিরাপদে মাছ ধরা যায়।

নিরাপত্তার সার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরণখোলার সাধারণ জেলে ও সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সুন্দরবনে যেতে তাদের ভয় লাগে।একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা নিরাপদ না। কারণ বনের পাশের জেলেপল্লী ও মৎস্য আড়তের আশেপাশে দস্যুদের সোর্সরা ঘোরাফেরা করে। তথ্য ফাঁসের বিষয় জানতে পারলে পরবর্তীতে বনে গেলে জেলেদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা এবং চাাঁদার হার আরো বেড়ে যায়। এই ভয়ে দস্যুদের বিরুদ্ধে জেলে বা মহাজন কেউই মুখ খুলতে সাহস পান না। সব সময় একটা আতঙ্ক তাড়া করছে তাদের। বনে জেলেদের পাঠালেই নৌকা প্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর কোনো জেলে অপহরণ হলে তার মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৫০ হাজার থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। একারণে অনেকে ভয়ে এখন বনে মাছ ধরতে যেতে চায় না। দ্রুত সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশণের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম ও সুন্দরবন রক্ষায় আমরা সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ জানান, ৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর সুন্দরবনে দস্যুদের আধিপত্য বেড়ে গেছে। সুন্দরবন সেই পূর্বের ভয়াবহ অবস্থায় ফিরেছে। বনজীবীরা বনে যেতে ভয় পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরাও আছেন আতঙ্কে। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলের অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বনদস্যুরা শুধু যে বনজীবী বা ব্যবসায়ীদের কাছে আতঙ্ক তা নয়, এরা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকি। কারণ দস্যুতার পাশাপাশি তারা বাঘ, হরিণ শিকার করে তার মাংস, চামড়া ও কঙ্কাল পাচার করে থাকে। এছাড়া বনের মূল্যবান কাঠ কেটেও তা পাচার করে। পূর্বের বনদস্যুরাও এমনইটাই করেছে। এসব বনদস্যু বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গডফাদার ও সোর্স। লোকালয়ে বসবাস করে এসব গডফাদাররা। বনদস্যু ও তাদের গডফাদারদের দমন করতে না পারলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা উচিৎ।

মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনে দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়। এর পর থেকে নিয়মিত অভিযানের পাশপাশি আমাদের বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ৩ অক্টোবর (২০২৫) পর্যন্ত গত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্টগার্ড। এসব অভিযানে ৪৪ জন বনদস্যু ও তাদের সহযোগীকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র, বিপুল পরিমান অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম, ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ, ২টি ককটেল এবং ৪৭৯টি স্পিন্টার। এছাড়া বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জন জেলেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। বনদস্যু দমনের পাশাপাশি সুন্দরবনের সব ধরণের অপরাধ নির্মূলে কোস্টগার্ড সচেষ্ট রয়েছে।সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করীম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বনজীবিদরে নিরাপত্তায় বনরক্ষীদের টহল জোরদার করা হয়েছে। দস্যুদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছি আমরা। বনদস্যুদমনে সম্মিলিত অভিযান পরিচালনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ চলছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

turan hossain rana