এইচ এম সাগর (হিরামন) :
দশটি স্বর্ণ পদক জয়ী খুলনা জেলার দিঘলিয়া এলাকার এ্যাথলেট মিরা খাতুন। ৪৬ বছর বয়সে এসে জীবনযুদ্ধে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। শেষ পর্যন্ত স্বর্ণপদক জয়ী মিরা দারিদ্রতাকে জয় করতে হাতে চায়ের কেটলি তুলে নিতে হয়েছে। ঘুড়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে কেটলি হাতে চা বিক্রয়ের মধ্যে দিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে প্রবল আত্মবিশ্বাসী এই নারী । তিনি ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৮ বছর ক্রীড়াঙ্গণে মিরার সাফলতা, কৃতিত্ব এবং খুবই পরিচিতি ছিলো।
এ সময়ের মধ্যে তিনি ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে জেলা বিভাগীয়, আঞ্চলিক, সেন্ট্রাল মিট, বাংলাদেশ গেমস ও মাস্টার্স গেমসসহ জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জনের মধ্য দিয়ে ১০টি স্বর্ণপদকসহ সর্বমোট ২০টি পদক অর্জন করেন। মিরার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের ক্রীড়ামোদী এক পরিবারে। মিরার চাচারা সবাই ছিলেন কৃতি ফুটবলার। ক্রীড়াঙ্গণে চাচাদের সুনাম ও কৃতিত্ব দেখে তিনি ছোটবেলা থেকেই এ্যাথলেটিক্সের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার বাড়ির সামনে দিঘলিয়া ওয়াইএমএ ক্লাবের বিশাল খেলার মাঠ। মিরা নিয়মিত সেখানে প্রাক্টিস করতেন।
দিঘলিয়া এমএ মজিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীত পড়াশুনা করাকালীন সময়ে ইন্টার স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১শ ও ২শ মিটার স্পিন্টার ও লং জাম্পে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর যশোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১শ মিটার, ২শ মিটার ও লং জাম্পে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে স্বর্ণপদক জয়ী হন। শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খুলনা বিভাগীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১শ মিটার ও ২শ মিটার দৌঁড়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
একই ইভেন্টে তিনি জাতীয় পর্যায়ে দুইবার স্বর্ণপদক পেয়েছেন। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)’র পক্ষে আঞ্চলিক পর্যায়ে ৮শ মিটার দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন তিনি। ঢাকায় আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৪র্থ জাতীয় বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণ করে ৮ম মিটার দৌঁড় প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ এবং ৪শ মিটার রিলে রেসে রৌপ্য পদক লাভ করেন। কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের পক্ষে অংশগ্রহণ করে ১শ মিটার, ২শ মিটার ও লং জাম্পে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে স্বর্ণপদক জয়ী হন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত মাস্টার্স গেমস প্রতিযোগিতায় ৪শ মিটার দৌড়ে ৪র্থ স্থান অধিকার করেন।
খেলোয়াড় জীবনে তার ২০টি পদক অর্জনের মধ্যে রয়েছে ১০টি স্বর্ণ,১৫টি ব্রোঞ্জ ও ৫টি রৌপ্য পদক। এছাড়া এ্যাথলেটার হিসেবে ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য প্রায় অর্ধশত সনদপত্র অর্জন করেছেন মিরা। সে ৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা ২৮ বছর এ্যাথলেটার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ৮ নং সুফলাকাঠি ইউনিয়নের শ্বশুর বাড়ির এলাকা ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। ছোটবেলা থেকেই মিরা খাতুনের দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই শুরু হয়েছে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। পিতা খায়রুল মোল্লা ছিলেন ব্যক্তি মালিকানাধীন জুট কোম্পানির শ্রমিক।
স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়ের খরচ যোগাতে তাকে হিমশিম খেতে হতো। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে মিরা ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নানা প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে তাকে সামনে অগ্রসর হতে হয়েছে। তিনি স্পোর্টসের পাশাপাশি পড়াশুনাও চালিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে এসএসসি এবং ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পাশ করার পর ভর্তি হন দৌলতপুর (দিবা/নৈশ্য) কলেজে। দারিদ্রতার কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। খেলাধুলার সুবাদে বিজেএমসিতে চাকরি হয়েছিলো তার।
৩/৪ বছর সেখানে চাকরি করার পর ভাগ্য সহায় হয়নি। তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও ৬ মাস পরে স্বামীর উপর অভিমান করে সংসার ছেড়ে চলে আসেন পৈত্রিক বাড়িতে । শেষ আশ্রয় ছিলো তার মা। তিনিও ঈদ-উল-আযহার কয়েকদিন পূর্বে মারা যান। তিন বছর পূর্বে বাবাও মারা যান। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর একমাত্র ভাই গোরা মোল্লাও স্টোক করে মারা যান। অসহায় মিরা খাতুনকে তার চাচারা সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজেকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে চান। চাকরি কিংবা অন্য কোন অবলম্বন না পেয়ে বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে চায়ের দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চা,পান,সিগারেট বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে মিরাকে। মিরা খাতুন বলেন,নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আছে। চা, পান,সিগারেট বিক্রি করে অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।
চাচারা সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা কত দিন সহযোগিতা করবে। এক সময় হয়তো তারাও ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এজন্য নিজে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছি। চা,পান,সিগারেট বিক্রিতে আমার কোন লাজ লজ্জা নেই। সৎ পথে রুজি করে বেঁচে থাকতে চাই। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি। দারিদ্রতা এখনও আমার কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর রহমতে সকলের সাহায্য ও দোয়ায় আমি সফলকাম হবো।