সর্বশেষ:

vikkha lathik hate jiboner ses[prante

ভিক্ষার লাঠি হাতে জীবনের শেষপ্রান্ত—ভুলে যাচ্ছে দেশ স্বাধীনতার এক নীরব নায়িকা গুরুদাসী মাসিকে মৃত্যুর ১৭ বছরেও নেই শ্রদ্ধা বা স্মরণ, অবহেলায় পড়ে আছে তার বসতঘর

vikkha lathik hate jiboner ses[prante
Facebook
Twitter
LinkedIn

এস,এম,আলাউদ্দিন সোহাগ,পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়—“কেউ কথা রাখেনি, ছত্রিশ বছর কেটে গেছে…।” খুলনা বিভাগের মানুষের স্মৃতিতেও আছে এমনই এক না–ফেরা নাম— বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসী। তিনি নেই আজ ১৭ বছর। তবুও তার মৃত্যুবার্ষিকী আসে, যায়—কিন্তু কেউ আর কথা রাখে না। সবাই ভুলে গেছে বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসিকে। মৃত্যুর ১৭ বছরেও নেই শ্রদ্ধা বা স্মরণ, অবহেলায় পড়ে আছে তার বসতঘর।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির সরকারি জায়গায় নির্মিত বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসির বসতঘর আজ পরিণত হয়েছে নেশাসক্তদের আড্ডাস্থলে। ঘরের আঙিনায় মলমূত্র ত্যাগ করে স্থানীয় কিছু অসচেতন মানুষ। ‘গুরুদাসী স্মৃতি রক্ষা’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও সেখানে নেই কোনো স্মৃতি সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ। ২০০৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করা এই বীরাঙ্গনার মৃত্যুবার্ষিকীও বর্তমানে কেউ পালন করে না। সবাই ভুলে গেছে বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসিকে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের গৃহবধূ গুরুদাসী মণ্ডল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও পাক হানাদারদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। যুদ্ধের শুরুতে পরিবার নিয়ে ভারতে পালালেও ‘সাধারণ ক্ষমা’র ঘোষণায় দেশে ফিরে আসেন। পরে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। গুরুদাসীর চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় স্বামী গুরুপদ মণ্ডল, দুই ছেলে অংশুপতি ও খোকন এবং মেয়ে অঞ্জলিকে। কোলে থাকা দুধের শিশু পারুলকেও আছড়ে ফেলে হত্যা করা হয়। এরপর গুরুদাসীর ওপর চলে বর্বর নির্যাতন।

মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেন এবং যুদ্ধ শেষে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। জীবনের বেশিরভাগ সময় মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় পাইকগাছা-কপিলমুনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে কাটান। হাতে একটি লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং মানুষের কাছে টাকা চেয়ে নেওয়াই ছিল তার জীবিকার উপায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ‘মা’ বলে সম্মান করলেও রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাননি।

২০০৮ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে কপিলমুনির ছোট্ট ঘরটিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন প্রতিবেশীরা জানালা দিয়ে তার মৃতদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। তার মৃত্যুর পরে স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধারা পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করলেও ঘরটির রক্ষণাবেক্ষণ বা স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। গুরুদাসীর মৃত্যুর পর স্থানীয়ভাবে ‘গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’ গঠিত হলেও গত ১৫ বছরে তাদের কার্যক্রম আর চোখে পড়েনি। তার বসতঘরকে স্মৃতিজাদুঘরে রূপান্তরের ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে কোন কাজ হয়নি। উল্টো তার মৃত্যুর পর ঘরটি দখলে নেওয়ারও অপচেষ্টা চালানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক গেজেটে গুরুদাসী মণ্ডলকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে এই স্বীকৃতি তিনি জীবদ্দশায় পাননি। উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের সাধারণ গৃহবধূ গুরুদাসী মণ্ডল, স্বামী গুরুপদ মণ্ডল ছিলেন দর্জি। চার সন্তানের হাসিখুশি সংসার। সরাসরি যুদ্ধে না গেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিলেন অকাতরে। ১৯৭১ সালের সেই কালরাত্রিতে তাদের বারোআড়িয়া গ্রামে হামলে পড়ে রাজাকার ও পাক হানাদাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার সন্দেহে শুরু হয় লোমহর্ষক নির্মমতা।

তার চোখের সামনে—স্বামী গুরুপদকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় দুই ছেলে—অংশুপতি ও খোকনকে, হত্যা করা হয় মেয়ে অঞ্জলিকে। কোলে থাকা দুধের শিশু পারুলকে ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলে হত্যা। তারপর শুরু হয় গুরুদাসীর ওপর পাশবিক নির্যাতন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করলেও তখন তিনি একেবারে সর্বহারা, মানসিক ভারসাম্যহীন। স্বাধীন দেশে বীরাঙ্গনা, জীবন শুরু হলো ভিক্ষার লাঠি হাতে—মুক্তিযুদ্ধের পর পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হলেও গুরুদাসী আর কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতেন। আবার ফিরে আসতেন পাইকগাছায়—স্বামী-সন্তানের স্মৃতির কাছে। ঘুরে ঘুরে বলতেন—“দশটা টাহা দে… খাব কি?”

এক হাতে কঞ্চির লাঠি, অন্য হাতে ভিক্ষার থালা। শিশুরা তাকে বলত—“রাজাকারের বউ!” তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতেন—“স্বামী-ছেলেমেয়া মাইরা আমারে ধরছে—আমি রাজাকারের বউ?” মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ‘মা’ বলতেন, সম্মান দিতেন। কিন্তু রাষ্ট্র? রাষ্ট্র দিল শুধু ভুলে যাওয়া আর উপেক্ষা। স্মৃতিজাদুঘর হবে—এ ঘোষণা আজও ঘোষণা রইল—তৎকালীন উপজেলার চেয়ারম্যান স.ম বাবর আলী, বাগেরহাট জেলা পরিষদের প্রশাসক শেখ কামরুজ্জামান টুকু এবং ইউএনও মিহির কান্তি মজুমদার আবাসন করে দিলেও তাতে সেবাযত্ন ছিল না। ২০০৮ সালে তার মৃত্যুর পর স্থানীয়ভাবে ‘গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’ গঠন হলেও কোনো কার্যক্রম আজও দৃশ্যমান নয়।

তার ঘরটিতে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরারা কিন্তু ১৪ বছরেও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। বরং তার মৃত্যুর পর সেই পাকা ঘর দখলের অপচেষ্টা চালায় কথিত ভূমিদস্যুরা। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এল তার মৃত্যুর ৮ বছর পর—মুক্তিযুদ্ধের সময় অসম্মান, মৃত্যুর পরও অবহেলা। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটে যে ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়—সেই তালিকায় আছে গুরুদাসী মণ্ডল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস গেজেটে নাম থাকলেও তিনি আজ আট বছর এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর পরও প্রশ্ন রেখে গেছেন গুরুদাসী মাসি এলাকাবাসী জানান —মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তিনি প্রায়ই বলতেন—“আজও তোরা ওদের বিচার করতে পারলি নে?”স্বামী-সন্তান হত্যার সেই হায়নাদের কথা বলতেন তিনি।

মৃত্যুশয্যায় তার শেষ কথা— “বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা কী পাইলাম? পাইলাম একখান লাঠি… আর তোদের পিঠে বাড়ি দিয়া বলি—দশটা টাহা দে।” এই প্রশ্ন আজও মুক্তিযোদ্ধাদের কানে বাজে—এবং এ দেশের বিবেকে। ৭ ডিসেম্বর—ভুলে যাওয়া এক মহান নারীর দিন পাইকগাছা, কয়রা, আশাশুনি—সবখানে মানুষ তাকে চিনত, তাকে মনে রাখে। কিন্তু তার জন্য নেই কোনো সরকারি স্মরণ, নেই কোনো শোকসভা। তার গল্প বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে—কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে। গুরুদাসী মাসী—যিনি নিজের সবকিছু হারানোর পরও বেঁচেছিলেন বাংলাদেশের পতাকার জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই। আজ তাকে স্মরণ করার এই লেখাই হয়তো হয়ে থাকবে তার প্রতি আমাদের ক্ষুদ্রতম দায় একটি জাতির লজ্জা, বেদনা এবং অপরিশোধিত ঋণের দলিল।

Facebook
Twitter
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

turan hossain rana