আমি যখন শিক্ষাজীবনে ছিলাম, তখন আমি সবসময় একজন মেধাবী এবং শীর্ষ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতাম, নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম এবং অবশেষে তা অর্জনও করেছিলাম। আমার হাতের ডিপ্লোমাটি ছিল আমার কঠোর পরিশ্রমের প্রমাণ, এবং যখন সেটি পেলাম, তখন মনে হয়েছিল যেন একটি বড় দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, যেন আমার কাঁধ থেকে একটি ভার নেমে গেছে। কিন্তু তখন আমি বুঝতে পারিনি, এই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে সফলতা অর্জনের পরেও, আমি বাস্তব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দক্ষতা শিখতে ব্যর্থ হয়েছি।
আমি একজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী ছিলাম, এবং আমার কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এই চাকরিটি পাওয়ার মাধ্যমেই জীবনে স্থিতিশীলতা আসবে এবং অর্থনৈতিক সাফল্য নিশ্চিত হবে। কিন্তু আজ, যখন আমার বয়স ৪০ এর কোঠায়, আমি বুঝতে পারছি যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন উন্নত নয়। আমি এখনো নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে জীবনযাপন করছি, যেখানে আমার আশেপাশের অনেকেই আর্থিকভাবে অনেক বেশি সফল হয়েছে, যদিও তারা একসময় একাডেমিক সাফল্যের শীর্ষে ছিল না।
আমার চাচাতো ভাই-বোনদের দিকে তাকালেই আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখতে পাই। তারা কেউই স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেষ্ঠ ছাত্র ছিল না, পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য দিনরাত পড়াশোনা করেনি, এবং প্রথম জীবনে উচ্চ বেতনের চাকরির নিশ্চয়তা পায়নি। বরং, তারা ঝুঁকি নিয়েছিল—তারা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছিল, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, এমনকি কখনও কখনও আমার কাছ থেকেও অর্থ ধার নিতে হয়েছিল। কিন্তু এখন, ৩০-এর কোঠায় পৌঁছে তারা সবাই আর্থিকভাবে সফল এবং স্বাবলম্বী।
অন্যদিকে, আমি যখন আমার কিছু বয়স্ক আত্মীয়দের দিকে তাকাই, যাদের জন্ম ১৯৭০-এর দশকে, তখন দেখি তাদের গল্পও একদম আলাদা। তারা একাডেমিক শিক্ষায় খুব বেশি অগ্রসর ছিল না, কেউ কেউ উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যায়নি। কিন্তু তারা বাস্তব জীবনের দক্ষতা অর্জন করেছিল এবং শূন্য থেকে নিজেদের জন্য সম্পদ গড়ে তুলেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও তারা একই নীতি অনুসরণ করেছে। তারা তাদের সন্তানদের শুধুমাত্র শীর্ষ ছাত্র হওয়ার জন্য কঠোর চাপ দেয়নি। বরং, তারা তাদের সামাজিকীকরণের সুযোগ দিয়েছে, বাস্তবজীবনের দক্ষতা শেখার জন্য উৎসাহিত করেছে এবং শেখার আনন্দ উপভোগ করতে শিখিয়েছে। তাদের সন্তানদের বড় হওয়ার সময় বারবার বলা হয়েছে—"আরাম করুন, শিখুন, বিনয়ী থাকুন"।
এখান থেকেই আমি বুঝতে পারছি যে শুধুমাত্র শিক্ষাগত সাফল্য জীবনের চূড়ান্ত সফলতার নিশ্চয়তা দেয় না। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্কুল ও পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেতে চাপ দেন, কারণ তারা মনে করেন যে এটি ভবিষ্যতে তাদের জন্য সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তবজীবনের দক্ষতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের জন্য সঠিক পথ চেনেন না এবং শুধুমাত্র সার্টিফিকেট ও পরীক্ষার ফলাফলের দিকে নজর দেন, অথচ বাস্তব জগতে টিকে থাকার জন্য আরও অনেক কিছু জানা দরকার।
আমার প্রশ্ন হলো—একাডেমিক সফলতা কি সত্যিই জীবনের সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয়? শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও উচিত তাদের সন্তানদের বাস্তবজীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখানো এবং কেবল পরীক্ষার নম্বর বা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য চাপ না দেওয়া। আমাদের বোঝা উচিত যে সাফল্য কেবলমাত্র পুঁথিগত শিক্ষার ওপর নির্ভর করে না, বরং বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে। তাই অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের জন্য আরও বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের ভবিষ্যত মূল্যায়ন না করা।