পাইকগাছা ( খুলনা ) প্রতিনিধি
খুলনার পাইকগাছায় উন্নয়নের নামে বাস্তবায়িত একটি সড়ক সংস্কার প্রকল্প এখন চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে। কাজ শেষ হওয়ার মাত্র ২০ দিনের মাথায় নতুন করে ঢালা কার্পেটিং উঠে যেতে শুরু করেছে। কোথাও পিচ খসে পড়ছে, কোথাও নিচের খোয়া বেরিয়ে আসছে। এতে প্রায় ৭০ লাখ টাকার সরকারি অর্থ কীভাবে ব্যয় হয়েছে—তা নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও প্রশ্নের ঝড় উঠেছে।
পাইকগাছা পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাটি এলাকায় বায়তুর নূর জামে মসজিদ থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) পর্যন্ত প্রায় ৭'শ মিটার সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-২ (IUIDP-2)’–এর আওতায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই প্রকল্পটি ছিল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। দিনের আলো এড়িয়ে রাতের আঁধারে কাজ, পর্যাপ্ত আলো ও ব্যারিকেডের অভাব এবং তদারকি প্রকৌশলীর অনুপস্থিতি—সব মিলিয়ে প্রকল্পটি যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্ধকারে সম্পন্ন করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের ইট ও খোয়া ব্যবহার করে বেসের কাজ শেষ করে রাতের বেলায় তড়িঘড়ি করে বিটুমিন ঢেলে কার্পেটিং করা হয়। কাজ চলাকালে দৈনিক বিডি নিউজ এ সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন-এর নজরে আসে। ওই রাতেই তিনি কাজ বন্ধ করে দেন এবং তদন্ত কমিটি গঠনের আশ্বাস দেন। তবে এলাকাবাসীর দাবি, কোনো তদন্ত ছাড়াই পরদিন আবার কাজ শুরু করে দ্রুত শেষ করা হয়। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তনুশ্রী এন্টারপ্রাইজ এর প্রোঃ মালিক বাবু রামের নেতৃত্বে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এখন সেই অনিয়মের ফল চোখের সামনেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন,
“রাতে কাজ দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা গড়বড় আছে। এখন ২০–২৫ দিনের মাথায় রাস্তার পিচ উঠে যাচ্ছে। এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা পরিকল্পিত লুটপাট।”
সচেতন মহল বলছে, —“যে রাস্তা বছরের পর বছর চলার কথা, সেটা এক মাসও টিকছে না। তাহলে বিটুমিনের মান কোথায় গেল? খোয়া কোথা থেকে আনা হয়েছে—এসবের জবাব কে দেবে?”
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—কাজ বন্ধ ও তদন্তের ঘোষণা থাকলেও কোনো তদন্ত কমিটির কার্যক্রম জনসমক্ষে আসেনি। বরং প্রশাসনের নীরবতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ শেষ করে ফেলে। আজ রাস্তার বেহাল দশা সেই নীরবতারই জবাব দিচ্ছে।
এখন জনসাধারণের প্রশ্ন—বিটুমিন ও নির্মাণসামগ্রীর মান পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না, তদারকি প্রকৌশলীর লিখিত ছাড়পত্র কোথায়, আর তদন্তের আশ্বাস দিয়ে কেন সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া হলো? তবে কি অর্থের বিনিময়ে সব প্রশ্ন চাপা দেওয়া হয়েছে?
সচেতন মহলের মতে, বিষয়টি আর স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। সরকারি অর্থের এমন প্রকাশ্য অপচয় ও সম্ভাব্য দুর্নীতির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সরাসরি তদন্ত এখন সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তনুশ্রী এন্টারপ্রাইজের মালিক বাবু রাম জানান, যে জায়গায় সমস্যা হয়েছে সেখানে বিটুমিন ঢেলে নতুন করে কাপেটিং দেওয়া হবে।
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী অতিরিক্ত দায়িত্বে নুর আহমদ জানান, "সড়কের সমস্যা দেখা দেওয়া স্থানগুলো দ্রুত সংস্কার করা হবে।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।”
উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে কাজ, তদন্ত ছাড়াই প্রকল্প সমাপ্তি এবং ২০ দিনের মাথায় পিচ উঠে যাওয়া—সব মিলিয়ে পাইকগাছার এই সড়ক আজ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দিকে কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর না মিললে সাধারণ মানুষের কাছে ‘উন্নয়ন’ শব্দটিই অর্থহীন হয়ে পড়বে।