কাশ্মীর, একটি ভূ-রাজনৈতিক নামমাত্র হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জটিল ও স্পর্শকাতর সমস্যা হিসেবে আজও রয়ে গেছে। ভারত, পাকিস্তান ও চীন—এই তিন পারমাণবিক শক্তির মধ্যে ত্রিমুখী টানাপড়েনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উপত্যকাটি। কিন্তু কেন এই ভূখণ্ড ঘিরে এত যুদ্ধ, রক্তপাত, বিদ্রোহ, সামরিক হস্তক্ষেপ? কীভাবে শুরু হলো এই সংঘাত? কাশ্মীরের ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বই বা কী? এই নিবন্ধে আমরা গভীরভাবে জানব কাশ্মীর ইস্যুর পেছনের কারণ, তার উৎপত্তি, সংঘর্ষের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে।
কাশ্মীর সংকটের শেকড় নিহিত ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের (পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম) সময়। ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ ত্যাগ করার সময় একটি নিয়ম স্থাপন করে: প্রত্যেক রাজ্য তাদের ইচ্ছামতো ভারত অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে। জম্মু ও কাশ্মীর ছিল এমন এক দেশীয় রাজ্য, যার শাসক ছিলেন হিন্দু (মহারাজা হরি সিং), কিন্তু জনগণের বেশিরভাগই মুসলমান। মহারাজা প্রথমে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন—না ভারত, না পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।
তবে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে উপজাতি-সশস্ত্র বাহিনী কাশ্মীরে আক্রমণ চালায়। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মহারাজা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি চুক্তি (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করেন। সেই সূত্রেই ভারত সেনা পাঠিয়ে কাশ্মীর দখলদারদের ঠেকায়। এরই মধ্যে শুরু হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭–৪৮), যার পরিণতিতে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করে এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control বা LoC) প্রতিষ্ঠিত হয়—যা কাশ্মীরকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়।
এই বিভক্ত কাশ্মীরের পশ্চিম অংশ চলে যায় পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে (আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান) এবং পূর্ব অংশ থেকে যায় ভারতের অধীনে (জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ)। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এরপরও ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে আরও দুটি যুদ্ধ হয় কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এই তিনটি যুদ্ধই পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে বারবার বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
কাশ্মীর ইস্যুর একটি গভীর দিক হচ্ছে—স্থানীয় জনগণের আত্মপরিচয়ের সংকট। অনেক কাশ্মীরি নিজেদের ভারতীয় বা পাকিস্তানি ভাবেন না; তারা চান স্বাধীন কাশ্মীর। ভারতীয় অংশের কাশ্মীরে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং জঙ্গি কার্যকলাপ বেড়ে যায়। ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে শুরু হয় উগ্রপন্থী আন্দোলন, যার পিছনে ছিল রাজনৈতিক বঞ্চনা, ধর্মীয় উগ্রতা, এবং বিদেশি প্রভাব। সেই থেকেই কাশ্মীর পরিণত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাঝে এক যুদ্ধক্ষেত্রে।
এই সংঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ কাশ্মীরিরা। হাজার হাজার প্রাণহানি, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক মন্দা, শিক্ষা ও চিকিৎসার পরিকাঠামোর ধ্বংস—সব মিলিয়ে একটি প্রজন্ম ধ্বংসপ্রায়। একদিকে ভারতীয় বাহিনীর নিরাপত্তার নামে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সন্ত্রাস—কাশ্মীর যেন প্রতিনিয়ত আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্নের নাম।
কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান একে শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, চীনকেও এই ইস্যুর সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। কাশ্মীরের উত্তরে রয়েছে চীনের সীমান্ত এবং অরুণাচল প্রদেশের মতো বিতর্কিত অঞ্চল। চীন ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে আকসাই চিন দখল করে নেয়, যা ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের অংশ ছিল। ফলে কাশ্মীর একটি ত্রিমুখী ভূখণ্ড—ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তার পানি, হিমবাহ এবং নদীগুলির জন্যও এই অঞ্চলটি অত্যন্ত মূল্যবান। সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলির উৎস এই অঞ্চলেই, যা পাকিস্তানের কৃষি ও জনজীবনের জন্য অবিচ্ছেদ্য। ভারতের নদী নিয়ন্ত্রণ নীতি পাকিস্তানের দৃষ্টিতে কাশ্মীরকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ফলে কাশ্মীর শুধু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যু নয়, এটি একটি জলসম্পদ এবং কৌশলগত দখলের লড়াইও।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এই পদক্ষেপ ভারত সরকারের দিক থেকে ছিল ‘পূর্ণ একীকরণ’-এর পদক্ষেপ, কিন্তু পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক মহলে এই সিদ্ধান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
কাশ্মীরবাসীর চোখে এটি এক ধরনের রাজনৈতিক অধিকার হরণ। ভারতের নানা জায়গা থেকে মানুষ এখন কাশ্মীরে জমি কিনতে পারেন, চাকরির সুযোগ পেতে পারেন—যা আগে নিষিদ্ধ ছিল। এর ফলে স্থানীয় জনগণ আশঙ্কা করে যে তাদের জনসংখ্যার কাঠামো পাল্টে দেওয়া হবে। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদি কারফিউ, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা, রাজনীতিকদের গৃহবন্দী অবস্থা—সব মিলিয়ে এই সময়টিকে অনেকে ‘আধুনিক কাশ্মীরের কালো অধ্যায়’ বলছেন।
বর্তমানে, ভারত সরকার কাশ্মীরকে উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও পর্যটনের দিক থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে এর পেছনে কঠোর সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও সেনা উপস্থিতির বাস্তবতা রয়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনও অভিযোগ তোলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে। অন্যদিকে, পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলতে চাইলেও, তার নিজের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলেও গণতান্ত্রিক ঘাটতি রয়েছে।
বর্তমানে লাদাখ অঞ্চলও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষে এই এলাকা ২০২০ সালে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সেনা নিহত হয়। এরপর থেকেই লাদাখে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় এবং চীন-ভারত সম্পর্ক আরও জটিল হয়। ফলে কাশ্মীর আজ আর শুধু ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়—এটি চীনকেও যুক্ত করে এক জটিল ভূরাজনৈতিক দাবা খেলায় পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীর সমস্যা শুধুই সীমান্ত, ধর্ম কিংবা রাজনীতির বিষয় নয়—এটি মানুষের অধিকার, পরিচয়, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের লড়াই। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অসমাপ্ত অধ্যায় এটি। একদিকে জাতীয় নিরাপত্তা, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে আজ কাশ্মীর ক্লান্ত। উন্নয়ন, শিক্ষা, সংলাপ এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই হতে পারে এই সংকটের টেকসই সমাধানের পথ। কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, আন্তরিকতা এবং জনগণের প্রকৃত কল্যাণের চিন্তার ওপর।