নিউজ ডেস্ক
মঙ্গলবার সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। যদিও অনেকেই ভূমিকম্পের সময় জেগে ছিলেন, কিন্তু তারা তা টের পাননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন অনেক পোস্ট দেখা গেছে যেখানে মানুষ লিখেছেন:
এ ধরনের প্রতিক্রিয়া নতুন নয়। আগেও ভূমিকম্পের সময় দেখা গেছে, কেউ টের পান, কেউ পান না। প্রশ্ন হলো, কেন একই স্থানে থেকেও ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়? এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা এবং অবস্থান বড় ভূমিকা পালন করে।
মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল তিব্বতের শিগেৎসে শহর। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.১। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এটি অনুভূত হলেও ঝাঁকুনির তীব্রতা বেশি ছিল না।
এর আগেও বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়েছে। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি মিয়ানমারের হোমালিন এলাকায় ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল, যা ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে। এটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকার মানুষ তা অনুভব করেছিলেন। প্রশ্ন হলো, এত দূরের ভূমিকম্প কেন বাংলাদেশে টের পাওয়া যায়? Visit our website today for more news.
অনেক সময় একই ভবনে থাকা দুই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। একজন ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি তীব্রভাবে অনুভব করেন, অন্যজন কিছুই টের পান না। এর পেছনে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ভূমিকম্প টের পাওয়ার ক্ষেত্রে ভবনের তলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু মানুষ গতি বা মোশন খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারেন। তাদের সংবেদনশীলতা তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে, যাদের সংবেদনশীলতা কম, তারা ভূমিকম্প টের পান না।
মঙ্গলবার সকালে আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেছেন,
এক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি স্থির থাকেন, তাহলে ভূমিকম্প অনুভব করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যারা চলাফেরায় ব্যস্ত থাকেন, তাদের টের পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে দূরত্বের ওপরেও টের পাওয়ার তারতম্য নির্ভর করে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে সবাই এটি টের পেলেও দূরের স্থানে এর তীব্রতা কমে যায়। ফলে কেউ টের পান, কেউ পান না।
ভূমিকম্প/Vumikompo ঘটে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের ভেতরের টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ সাতটি বড় এবং অসংখ্য ছোট প্লেট দিয়ে গঠিত। এগুলো ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং যখন একে অপরকে ধাক্কা দেয়, তখন শক্তি সঞ্চিত হয়। একপর্যায়ে সেই শক্তি ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে, ফলে ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন অনুভূত হয়। এটিকেই ভূমিকম্প বলা হয়।
যেসব স্থানে টেকটোনিক প্লেট একে অপরকে ধাক্কা দেয় বা সংযোগ স্থাপন করে, সেসব এলাকাকে ফল্ট লাইন বলা হয়। বাংলাদেশের প্রধান ফল্ট লাইনগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাউকি ফল্ট, যা শেরপুর থেকে জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত।
যেখানে ভারি প্লেট হালকা প্লেটের নিচে সরে যায়, সেসব এলাকাকে সাবডাকশন জোন বলা হয়। বড় ভূমিকম্প সাধারণত এই এলাকাগুলোতে ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে, বড় ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান ৮০০ থেকে ৯০০ বছর।
বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত—ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা প্লেট। ফলে এটি ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ।
আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন:
ড. শাখাওয়াত হোসেনের মতে, বাংলাদেশ জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ না হলেও, দেশের বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হয় না। বড় ভূমিকম্প হলে অনেক ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভূমিকম্প পরিমাপ করার জন্য দুটি মূল স্কেল ব্যবহৃত হয়—রিখটার স্কেল এবং মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল।
ভূমিকম্প প্রতিরোধে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রথমত, বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণকাজ করা অত্যন্ত জরুরি। ভবন তৈরির সময় আধুনিক ভূমিকম্প প্রতিরোধক প্রযুক্তি এবং নকশা ব্যবহার করা উচিত। পুরনো ভবনগুলোতে রেট্রোফিটিং (পুনর্বাসন) প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সেগুলোকে ভূমিকম্প-সহনশীল করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, সচেতনতা বৃদ্ধি করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সাধারণ মানুষকে ভূমিকম্পের সময় কী করণীয় এবং কীভাবে নিরাপদ থাকা যায়, তা শেখানোর জন্য নিয়মিত মহড়া ও কর্মশালা আয়োজন করা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতির উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
তৃতীয়ত, জরুরি সেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেল টিম এবং উদ্ধারকারী দলকে প্রশিক্ষিত করা এবং তাদের কাছে আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চিত করা জরুরি। জরুরি সময়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা আবশ্যক।
চতুর্থত, ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাসের প্রযুক্তি উন্নত করা প্রয়োজন। উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া গেলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এছাড়া শহর পরিকল্পনা এবং আবাসিক এলাকা উন্নয়নে ভূমিকম্প-সহনশীল নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি, ভূমিকম্প প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সবাইকে সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো সম্ভব নয়। তবে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
সবার আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং কর্মক্ষেত্রে ভূমিকম্প মোকাবিলার কৌশল শেখানো উচিত।
নতুন ভবন নির্মাণের সময় সঠিক বিল্ডিং কোড মেনে চলা আবশ্যক। পুরোনো ভবনগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য সংস্কার করা জরুরি।
ভূমিকম্পের পর দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত দল গঠন করা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংরক্ষণ করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ হওয়ায় এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সবারই উচিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ড. শাখাওয়াত হোসেন বলেন:
ভূমিকম্প টের পাওয়া বা না পাওয়ার পেছনে মূল কারণ হল ব্যক্তির সংবেদনশীলতা, অবস্থান, এবং ক্রিয়াকলাপ। উপরের তলায় থাকা বা স্থির অবস্থানে থাকা মানুষ ভূমিকম্প সহজে টের পান। কিন্তু যারা চলাফেরা করছেন বা ব্যস্ত রয়েছেন, তারা অনেক সময় এটি বুঝতে পারেন না।
ভূমিকম্প সাধারণত প্লেট টেকটোনিক আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে থাকা প্লেটগুলো যখন সরতে থাকে, তখন একটি ফল্ট লাইনে চাপ সৃষ্টি হয়। সেই চাপ নির্গত হলে ভূমিকম্প হয়।
হ্যাঁ, বাংলাদেশ একটি মডারেটলি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। ডাউকি ফল্ট ও অন্যান্য ফল্ট লাইন বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়।
ভূমিকম্পের মাত্রা মাপার জন্য রিখটার স্কেল বা মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল ব্যবহার করা হয়। এটি কম্পনের তীব্রতা এবং শক্তি নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছিলো, যা ঢাকা ও আশেপাশে অনুভূত হয়।
ভূমিকম্প/Vumikompo একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তবে এর জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব। সচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক পরিকল্পনা এবং বিল্ডিং কোড মেনে চলার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সচেতনতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি।