সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী পদ্মা–মেঘনা–ব্রহ্মপুত্র নদীবাহিত অঞ্চলে বিস্তৃত এক বিশাল ম্যানগ্রোভ বন কাঠামো। এটি মূলত বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত। মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিমি, যার মধ্যে বাংলাদেশ অংশের জায়গা প্রায় ৬৬% (৬,৫১৭ বর্গকিমি) এবং ভারত অংশ প্রায় ৩৪%। সুন্দরবন একটি জটিল নদীজাল, খাঁড়ি ও দ্বীপনির্ভর অঞ্চল যেখানে প্রকৃতি নিজের ছন্দে টিকে আছে শত শত বছর ধরে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন নেই, যা একে অনন্যতা দিয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী তালিকায় বাংলাদেশ অংশ ১৯৯৭ সালে এবং ভারতের অংশ পৃথকভাবে যুক্ত হয়েছে। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ০.৯ মিটার থেকে ২.১১ মিটার পর্যন্ত, ফলে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চলগুলোর একটি। প্রাকৃতিক সীমানা ছাড়াও এটি দুই দেশের সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে। একদিকে যেমন এটি উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবেও বিবেচিত। সুন্দরবনের আয়তনের বৃহৎ অংশ নদী ও খালের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এটি এক রহস্যময় জঙ্গল হিসেবে বিশ্বের পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে।
সুন্দরবনে দুই ধরনের পরিবেশভিত্তিক বনাঞ্চল দেখা যায়—লবণাক্ত পানির ম্যানগ্রোভ বন এবং স্বাদু পানির আর্দ্র বনাঞ্চল। এই বৈচিত্র্য প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং জলবায়ু ও নদীবাহিত পলিমাটির গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের সবচেয়ে পরিচিত গাছ ‘সুন্দরী’, যার নামেই বনটির নামকরণ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Heritiera fomes। এছাড়াও গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, বাইন, ধুন্দুল, ঝামটি, হেঁতাল, গোলপাতা, কাঁচা গোলপাতা এবং আরও অনেক প্রজাতির গাছ রয়েছে। বনবিভাগের ১৯০৩ সালের জরিপ অনুযায়ী এখানে ২৪৫ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি ছিল। বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের গঠন ও বংশবিস্তার পদ্ধতি তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাইন গাছের মূল মাটির ওপর দিয়ে উপরে উঠে থাকে যেন শ্বাস নিতে পারে। সুন্দরবনের উদ্ভিদরাজি শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্য নয়, বরং উপকূলীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই গাছগুলোর শিকড় ও পাতার গঠন ভূমি ক্ষয় রোধ করে এবং দুর্যোগকালে ঢেউয়ের গতি হ্রাস করে। এর ফলে এই বন শুধু পরিবেশগত নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।
সুন্দরবন প্রাণীবৈচিত্র্যের দিক থেকেও অতুলনীয়। এই বনে বাস করে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং দুর্লভ প্রাণী—রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ২০১৫ সালের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ অংশে প্রায় ১০৬টি বাঘ রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণ, যাদের বাঘের প্রধান খাদ্য হিসেবে ধরা হয়। সুন্দরবনে বন শূকর, বানর, বন বিড়াল, বন্য খরগোশ এবং সজারুর মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির সরীসৃপ যেমন—লবণাক্ত পানির কুমির, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও কচ্ছপ। পাখির দিক থেকেও এই বন সমৃদ্ধ। প্রায় ২৯০ প্রজাতির পাখি এখানে পাওয়া যায়, যার মধ্যে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ঈগল, রাজধনেশ, পেঁচা উল্লেখযোগ্য। জলজ প্রাণীর মধ্যে রয়েছে শুশুক, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক ও অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এই প্রাণীগুলো শুধুমাত্র বন ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করছে না, বরং উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু দূষণ, চোরাশিকার এবং বাসস্থান ধ্বংসের ফলে এদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে এখনই প্রয়োজন কার্যকর সংরক্ষণ উদ্যোগ।
সুন্দরবন শুধু একটি বন নয়, বরং লাখ লাখ মানুষের জীবনের অবলম্বন। উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণ মধু সংগ্রহ, মাছ ধরা, কাঁকড়া ও শামুক সংগ্রহ, পাতা ও কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া এই বন থেকে পাওয়া যায় হার্ডবোর্ড, পেপার মিলের কাঁচামাল, নৌকা তৈরির কাঠ এবং আসবাবপত্রের জন্য ব্যবহৃত কাঠ। বনজ সম্পদের মধ্য দিয়ে দেশে রাজস্ব আদায় হয় এবং দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। সুন্দরবনের গোলপাতা ঘরের ছাউনির জন্য বহুল ব্যবহৃত। এছাড়াও স্থানীয় লোকেরা জ্বালানির জন্য গাছের ডাল ও পাতা ব্যবহার করে। সুন্দরবনের পরিবেশগত উপকারিতাও অসাধারণ—এটি উপকূলকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে, মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। বনভূমির প্রতিটি গাছ ও খালের প্রত্যেকটি ফোঁটা পানি প্রত্যক্ষভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। পরোক্ষভাবে এটি বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপরও দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুন্দরবন এলাকার মানুষজন মৌচাক তৈরি, মাছ চাষ, কাঁকড়া সংগ্রহ, গাছের চারা তৈরি এবং ইকো-ট্যুরিজমে জড়িত হয়ে আয় করে থাকে।
সুন্দরবন বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম বড় হুমকি, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বনভূমি ধ্বংস করে দিতে পারে। গবেষণা বলছে, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে সুন্দরবনের ৭৫% হারিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় এই বনভূমির বিপুল ক্ষতি করেছে। কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানুষও সুন্দরবনের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। চোরাশিকারিরা বাঘ, হরিণ ও অন্যান্য প্রাণী হত্যা করছে। বনদস্যুদের উপস্থিতি জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন উজাড় ও অপরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়ন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা সুন্দরবনের নিকটে নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে দূষণ বেড়ে যেতে পারে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। নদী-নালা ভরাট, কাদা পলি জমে জলপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো, অবৈধভাবে বনজ সম্পদ আহরণ এবং শিল্পবর্জ্য ফেলা বনাঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকি। এসব সমস্যা মোকাবেলায় সরকার ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
সুন্দরবনের সংরক্ষণে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ অংশে তিনটি অভয়ারণ্য রয়েছে—পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম। এসব অভয়ারণ্য বাঘ, হরিণ ও অন্যান্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল। ভারতীয় অংশে রয়েছে সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান ও ব্যাঘ্র প্রকল্প। এছাড়া বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসেবে ভারতীয় অংশ বিশেষভাবে সংরক্ষিত। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের র্যাব জলদস্যু ও বনদস্যু দমনে অভিযান পরিচালনা করছে, যার ফলে অনেক দস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর নানা ধরনের জনসচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হয়, যা জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সুন্দরবন সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ, জীববৈচিত্র্য তথ্যভাণ্ডার, আধুনিক বনায়ন কৌশল এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন WWF, IUCN ও UNDP বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবন সংরক্ষণে অবদান রাখছে। ভবিষ্যতে সুন্দরবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সরকারের উদ্যোগ নয়, প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা ও ভালোবাসাও জরুরি।
সুন্দরবন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই বন তার জটিল গঠন, বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ গাছ এবং বিস্তৃত জলজাল দিয়ে উপকূলকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা বিস্তার থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে বাঁচাতে সুন্দরবন এক অতুলনীয় ঢাল হিসেবে কাজ করছে।
ঘূর্ণিঝড় 'সিডর' (২০০৭), 'আইলা' (২০০৯), 'ফণী' (২০১৯) এবং সাম্প্রতিক 'আম্পান' (২০২০) এর মত প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেখা গেছে সুন্দরবনের সজীব বনাঞ্চল ঢেউ ও ঝড়ো বাতাসের গতি রোধ করে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে হ্রাস করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের কারণে উপকূলবর্তী জনপদের ক্ষয়ক্ষতি অন্তত ৩০-৪০% পর্যন্ত কমে যায়।
ম্যানগ্রোভ গাছের বিশেষ শ্বাসমূল ও বিস্তৃত শিকড় জলপ্রবাহকে ধীর করে এবং কাদামাটি আটকে রাখে, যার ফলে ভূমিক্ষয় রোধ হয় এবং নদী বা সমুদ্র থেকে আসা ঢেউ উপকূলে তীব্র আঘাত হানতে পারে না। তাছাড়া সুন্দরবনের পলিমাটি জমা দেওয়ার প্রাকৃতিক পদ্ধতি উপকূলীয় ভূপৃষ্ঠকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবে নিমজ্জিত হওয়া থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে।
এছাড়াও সুন্দরবন অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং লবণাক্ততা বিস্তারের গতি কমিয়ে কৃষির জন্য একটি সহনশীল পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রতিনিয়ত লবণাক্ত জল ঢুকে পড়ার সময় ম্যানগ্রোভ গাছপালা একধরনের প্রাকৃতিক ছাঁকনির কাজ করে, যা পানির মান উন্নত করে এবং মাটির উর্বরতা রক্ষা করে।
বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এক বিশাল ঝুঁকির মুখোমুখি, আর এই প্রেক্ষাপটে সুন্দরবনের অস্তিত্ব কেবল একটি বনাঞ্চল নয়, বরং একটি পরিবেশগত বাঁধ, যা কোটি কোটি টাকার অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ছাড়াই দুর্যোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এই কারণে, সুন্দরবন সংরক্ষণ মানে শুধুই জীববৈচিত্র্য রক্ষা নয়—এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, বসতি, কৃষি ও অর্থনীতিকে ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ রাখার একটি কৌশলগত প্রাকৃতিক বর্ম।