
বটিয়াঘাটা (খুলনা) প্রতিনিধি :
বটিয়াঘাটার সুখদাড়ায় বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর- অগ্নিসংযোগ ঘটনায় চার বছর আগের মামলা করে চমক দিয়েছেন আওয়ামী লীগের খুলনা জেলা সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া হালের বিএনপি পরিচয়দানী আবু বক্কর শেখ। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি দায়ের করা ওই মামলায় আসামী হয়েছেন খোদ বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনটির একাধিক নেতাসহ স্থানীয় সাংবাদিক এবং পুজা উদযাপন কমিটির নেতারও। এ মামলাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা সুযোগ সন্ধানী আবু বক্করের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএনপি ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর প্রতি দাবি জানিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, মামলায় নাম সংযুক্ত ও কর্তনের করার মাধ্যমে অর্থ বাণিজ্য করছে আবু বক্কর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর বটিয়াঘাটার সুখদাড়া বাজারে বিএনপি অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গেল ৬ মার্চ বটিয়াঘাটা থানায় সুখাদাড়া গ্রামের মৃত হোসেন আলী শেখের পুত্র মো: আবু বক্কার শেখ এজাহার দায়ের করেন। মামলা নম্বর-০৭, তাং-০৬/৩/২০২৫ ইং। ওই মামলায় আসামী করা হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এ মামলার আসামী তালিকায় রয়েছেন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, পূজা উদযাপন পরিষদ, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা।
মামলার এজাহারে আবু বক্কর শেখ নিজেকে বিএনপির বটিয়াঘাটা থানা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি দাবি করলেও তিনি জুলাই অভ্যুত্থাণের আগে ছিলেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই আবু বক্কার শেখ বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে যায়। পরবর্তীতে ২০১২-১৩ সালে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদের হাতধরে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তারপর থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরব ছিল আবু বক্কর। ওই সময়ে তার দাপটে অনেকেই ছিলেন অসহায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফের খোলস পাল্টায় ওই আবু বক্কর। এবার বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনায় দলের নেতাকর্মীদের আসামী করে নতুন বির্তক সৃষ্টি করে সুযোগ সন্ধানী আবু বক্কর। তাঁর দায়ের করার মামলায় আসামী হয়েছেন বারোভূইয়া ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আহম্মদ আলী মোল্যা, সুখদাড়ার ছাত্রদলের নেতা বলয় রায়, বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বেনজির আহম্মেদ,৭ নং টালিয়ামারা ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রুবেল বিশ্বাস, থানা বিএনপির সাবেক শিশু ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক এনামুল গাজী। আসামী হয়েছেন বটিয়াঘাটা উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব মানস পাল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চয়ন বিশ্বাস, সুখদাড়া পূজা কমিটির সভাপতি অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক প্রনব মিস্ত্রী, গরিয়ারডাঙ্গা কলেজের অফিস সহকারী দিলীপ মিস্ত্রী, পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা পরিমল রায়, ইউপি সদস্য এসএম ফরিদ রানা, ইউপি সদস্য রুহুল আমিন মোল্যা, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য মিজানুর রহমান, মসজিদের ইমাম তরিকুল ইসলাম, ভ্যান চালক রউফ শেখ, দিনমজুর আকরাম হোসেন, রাজমিস্ত্রী মোজাফ্ফার মোল্যা। আর মামলায় প্রধান আসামী করেছেন বিগত ইউপি নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউপি সদস্য রমেনন্দ্রনাথ রায়কে।ভূক্তভোগীরা বলেছেন, গত ৫ আগষ্ট২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সুকৌশলি বক্কার বিএনপিতে পূনর্বাসন হওয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করতে থাকেন। নিজেকে বিএনপির রাজনীতিতে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি মামলার মিশন কাজে লাগনোর চেষ্টা করেন। তার এমন ঘটনার তথ্য বিএনপির শিবিরে জানাজানি হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বক্কর শেখের ছবি ফেসবুকে কয়েকদিন ভাইরাল হতে থাকে। ফলে তার মিশন ওই সময় থমকে দাড়ায়। এই সুযোগে ১০৭ জনের তালিকা তৈরী করে সে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেন। মামলার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
ইউপি সদস্য বারোভূইয়া গ্রামের রুহুল আমিন মোল্লা বলেন, আমাকে মামলায় আসামী করবে না মর্মে বক্কর শেখ তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে কয়েক হাজার টাকা গ্রহণ করেন। আমার জানামতে ওইদিন আরও কয়েক জনের কাছ থেকে সে টাকা গ্রহণ করেন।নাম প্রকাশ্যে অনুচ্ছুক সুরখালী ইউপির বর্তমান এক সদস্য জানান, প্রায় চার মাস আগে ৭ ডিসেম্বর বক্কর শেখ খুলনার আদালত পাড়ায় আমাকে কাগজপত্র দেখিয়ে মামলা থেকে আমার নাম বাদ দেয়ার কথা জানায়। স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর মামলায় স্বাক্ষী করা হয়েছে সুরখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, নৌকার ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটুর ডানহাত হিসেবে পরিচিত সুরখালী গ্রামের মিন্টু মালীকে। মিন্টু মালীর বিরুদ্ধে রয়েছে ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলা ও হত্যা মামলা। এমন একজন লোককে কিভাবে দলীয় মামলার সাক্ষী করা হলো এ বিষয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য নুরুননাহার বেগম বলেন, আমার স্বামী রুবেল বিশ্বাস বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত, টালিয়ামারা ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক, তারপরও বিএনপির অফিস ভাঙচুর মামলায় কিভাবে আসামী করা হয়েছে বুঝিনা। উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক(নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক) দাবি করেন, মামলার ২৮ নম্বর আসামী বারোভূইয়া গ্রামের আহম্মদ আলী মোল্যা ওয়ার্ড বিএনপির নেতা। তার নামে মামলা হওয়া খুবই দু:খজনক। তাছাড়া বাদী তো বিএনপির কেউ না। এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিএনপিতে পুনর্বাসন হওয়ার টার্গেট নিয়ে আলোচিত বক্কার এই মামলার বাদী সেজেছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। সুরখালী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মোঃ মারুফ হোসেন জমাদ্দার তার ভেরিফাইড ফেসবুকে খুলনা জেলা বিএনপির দৃষ্টি আকর্ষন করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘যাহারা আওয়ামী দূঃশাসনের ১৪ বছরে কোন মামলা খায়নি,কখনও পালাতে হয়নি, শেষ ৫/৭ বছরের মধ্যে কোন মিছিল-মিটিং এ পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের সাথে মিশে প্রচুর টাকা-সম্পদ কামিয়েছে। নিজেকে আওয়ামী লীগ বানাতে গিয়ে অতি মাত্রায় অতি উৎসাহী হয়ে, বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামী করতে তালিকা তৈরী করে দিয়েছে। পুলিশকে অর্থ দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছে। তারাই দেখছি এখন সুরখালী এরিয়ার বিএনপির নিয়ন্ত্রক। সদ্য একটি বিএনপির অফিস ভাংগার মামলার উদ্ভব হয়েছে। সেখানে দেখতে পাবেন-উক্ত মামলার বাদী, স্বাক্ষী, আসামী বিগত দিনে বিভিন্ন সময় একই আওয়ামী মঞ্চে ছিল এবং আওয়ামীলীগের কোন রাঘববোয়াল বা ভাইটাল পোস্টধারী লোককে আসামী করা হয়নি এই মামলায়। বরঞ্চ ঐসব রাঘব-বোয়ালদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে, তাদেরকে নিরাপদে রাখতে নামমাত্র কিছু আওয়ামী লোকের সাথে সাধারণ কিছু লোকের নাম দিয়ে মামলাটি করা হয়েছে। প্রকৃত ভাবে যে সকল আওয়ামীলীগ এর লোক নির্যাতন করেছে, পরিকল্পনা করেছে তাহারা ধরা ছোয়ার বাইরে। অপর কলামে লিখেছে “গণ হত্যা মামলার আসামী বিএনপির অফিস ভাংগা মামলার স্বাক্ষী ” ইত্যাদি…।’
সুখদাড়া গ্রামের বাসিন্দা গরিয়ারডাঙ্গা কলেজের শিক্ষক দিলীপ মিস্ত্রী বলেন, এটি একটি মিথ্যা সাজানো হয়রানিমুলক মামলা। পুলিশ প্রশাসনের ঊচিত ছিলো, মামলাটি গ্রহণ করার আগে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করা। তাহলে সত্য ঘটনা প্রকাশ পেত। বটিয়াঘাটা উপজেলা বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক এজাজুর রহমান শামীম বলেন, এই মামলা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আওয়ামীলীগের সঙ্গে লেয়াজু করে চলা মানুষ এমন একটা রাজনৈতিক মামলার কিভাবে সাক্ষী বা বাদী হয় তা আমার বোধগম্য নয়।