
অ্যাড: এফ,এম,এ রাজ্জাক :
শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণা ও উৎসবের দিন ১ মে। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে আত্মহুতিদানকারী শ্রমিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর প্রথম প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের দাবী তোলে। শ্রমিকরা ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে ধর্মঘট ডাকে। এ ধর্মঘটে যোগ দেয় ৩ লক্ষ শ্রমিক। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩ ও ৪মে শ্রমিকদের এক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সাজানো মামলায় ফাঁসি দেয়া হয় ৪ জন শ্রমিককে। আন্দোলন রক্তাক্ত হলেও বহু প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবী আদায় হয়। বহু প্রতিষ্ঠানের কাজের ঘণ্টা কমানো হয়।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে ৮ ঘণ্টা দাবী আদায়ে শিকাগো শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, প্রতি বছর ১মে দিনটি ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করা হবে। এভাবেই শুরু হয় মে দিবস। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১মে থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণী দিবসটি পালন করে আসছে আন্তর্জাতিক সংহতি ও উৎসবের দিন হিসাবে।
ন্যায্য অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের আত্মহুতি দানের এই গৌরবদীপ্ত ইতিহাস যুগ যুগ ধরে শ্রমিকদের উজ্জীবিত করে তাদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে। সময় পেরিয়ে পৃথিবী আজ একবিশ শতাব্দিতে। সর্বক্ষেত্রে আধুনিকায়নের ঝড় উঠলেও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এখনও চলছে। শ্রমিকরা এখনও মালিকের স্বেচ্ছাচারিতা ও শোষণের শিকার।
আমেরিকার শিকাগো শহরের শহীদ শ্রমিকদের অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয় দাবী আদায়ে সংগ্রামী ও অঞ্চলের শ্রমিকরা। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে রেল, চা বাগান, ও স্টীমার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংহতি বৃটিশদের কাঁপিয়ে তোলে। পরবর্তীকালে সুতাকলসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক দাবী আদায়ের জন্য সংগঠিত হয়। এসময় গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়নসমূহ মে দিবস পালনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু অধিকাংশ স্থানে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় গোপনে গোপনে মে দিবস পালিত হয়।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মে দিবস পালিত হয় নারায়নগঞ্জে। মে দিবসে ছুটি চেয়ে দাবী ওঠে সর্বত্র। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে সর্বত্র উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় মে দিবস। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয় ব্যাপকভাবে পালিত ১মে কে ছুটির দিন হিসাবে।
ব্রিটিশ সময়কাল থেকে এদেশের শ্রমিকরা একদিকে যেমন দাবী আদায়ের আন্দোলন করছে অন্যদিকে শিল্প রক্ষার্থেও রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মালিকানা যখন তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মূল শিল্প সুতাকলগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল তখন সুতাকল শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ডাকে কারখানা চালিয়ে জার্মানদের বিরোধী সহযোগী শক্তির যুদ্ধাহতদের জন্য ব্যান্ডেজ ইত্যাদি চিকিৎসা সরঞ্জামাদি তৈরী করেছে। পাকিস্তান আমলেও পাটকল শ্রমিকরা ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে ২১ ও পরে ৪৬ দিন ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ৪৬ দিন একনাগাড়ে ধর্মঘট করেছে। সরকারী কর্মচারীদের ট্রের্ড ইউনিয়নের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘মোনাজাত’ আন্দোলন করে। এখনও চলছে নির্যাতন, নিষ্পেষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম।
খেটে খাওয়া মানুষের জন্য মে দিবসের চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক। যদিও নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় মে দিবসের তাৎপর্য নতুনভাবে আবিষ্কার করা হচ্ছে। শ্রমিকদের গর্ব, অনুপ্রেরণা ও শপথের দিন অঙ্গিকার নিয়ে আসবে শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থে তথা সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে।