বিশ্বে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের জীবন ও কর্ম ধরা পড়ে ইতিহাসের পাতায়, আর হৃদয়ে গেঁথে থাকে লক্ষ কোটি মানুষের। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এভুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম, সংক্ষেপে এ. পি. জে. আবদুল কালাম। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, শিক্ষক ও একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাঁর চিন্তাধারা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, এবং তরুণদের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে করে তুলেছে ভারতের "জনতার রাষ্ট্রপতি"।
তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় কিভাবে আত্মত্যাগ, অধ্যবসায় ও শিক্ষার মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন। এই প্রবন্ধে তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক, অবদান এবং আমাদের জন্য কী শিক্ষণীয় রয়েছে তা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
এ. পি. জে. আবদুল কালাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর, ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম নামক ছোট একটি দ্বীপ শহরে। তাঁর পিতা জয়নুল আবেদিন ছিলেন একজন নৌকা মালিক এবং ইসলাম ধর্মবিশ্বাসে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। তাঁর পরিবার ছিল আর্থিকভাবে মধ্যম বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত।
শৈশবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছোটবেলায় পত্রিকা বিলি করে সংসারে সহায়তা করতেন, আবার সেই সাথে পড়াশোনা করতেন নিষ্ঠার সাথে। তিনি তামিলনাড়ুর “শোয়ার্টজ হাইস্কুল” থেকে স্কুলজীবন শেষ করেন এবং পরে সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন।
এরপর তিনি Madras Institute of Technology (MIT) থেকে এয়ারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শিক্ষাজীবন ছিল তাঁর ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।
পড়াশোনা শেষে আবদুল কালাম যোগ দেন ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (DRDO)-তে, তারপর কাজ করেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO)-তে। তিনি ভারতের প্রথম স্বনির্ভর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প SLV-III-এর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন।
তিনি ভারতের একাধিক মিসাইল প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—অগ্নি, পৃথ্বী, ত্রিশূল, আকাশ ও নাগ। এ সকল প্রজেক্টের সাফল্যের ফলে তিনি “Missile Man of India” নামে পরিচিতি পান।
১৯৯৮ সালে ভারতের পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা (Pokhran-II) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়। এই পরীক্ষার পেছনে কালামের অবদান ছিল অগ্রগণ্য।
২০০২ সালে এ. পি. জে. আবদুল কালাম ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাঁর প্রচারহীন জীবন, বিজ্ঞানী হিসেবে অবদান এবং সর্বজনগ্রাহ্যতা তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে সাহায্য করে।
তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও এক সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। তিনি দেশজুড়ে স্কুল-কলেজে ঘুরে বেড়িয়ে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে দেখা করতেন, তাদের অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি বলতেন—
"Dream is not that which you see while sleeping, it is something that does not let you sleep."
তিনি সবসময় বলতেন, “তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ।” তাই তিনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতেন বড় স্বপ্ন দেখতে ও নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে।
ডঃ কালামের আত্মজীবনী “Wings of Fire” একটি বেস্টসেলার বই, যেখানে তাঁর জীবনের সংগ্রাম, ব্যর্থতা ও সফলতার অনুপম কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
Ignited Minds
India 2020
Mission India
My Journey
Turning Points
এই বইগুলোতে ভারতের উন্নয়ন, তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতা ও স্বপ্নের দিশা খুঁজে পাওয়া যায়।
কালাম নিজের জীবনে কখনও বিলাসিতা গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রপতির বাসভবন ত্যাগ করার সময় তাঁর সাথে ছিল মাত্র একটি ব্যাগ, কিছু বই ও একটি ল্যাপটপ।
তিনি কখনও নিজের কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করেননি। সবসময় বলতেন, “আমি একজন শিক্ষক। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।”
১. স্বপ্ন দেখতে হবে – কারণ বড় কিছু করতে হলে আগে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়।
পরিশ্রম করতে হবে – শুধুমাত্র স্বপ্ন নয়, তার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করতে হবে।
ব্যর্থতাকে গ্রহণ করুন – ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়; এটি হলো শেখার শুরু।
আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন – নিজের উপর বিশ্বাস না থাকলে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়।
নৈতিকতা ও দেশপ্রেম – নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও সৎ জীবনযাপন সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৫ সালের ২৭ জুলাই, মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত IIM Shillong-এ তিনি “Creating a Livable Planet Earth” শিরোনামে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঞ্চেই লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তাঁর মৃত্যু সংবাদে সমগ্র ভারত শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
অবদান | ব্যাখ্যা |
---|---|
অস্ত্রপ্রযুক্তিতে উন্নয়ন | ভারতের মিসাইল প্রযুক্তি ও আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পথিকৃৎ |
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন | শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের প্রচেষ্টা |
উদ্ভাবনী চিন্তাধারা | তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা |
জাতীয় গর্ব | পারমাণবিক সফলতা, রাষ্ট্রপতি হিসেবে গর্বের প্রতীক |
নেতৃত্বের মানসিকতা | রাজনীতি, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা—সব কিছুর মিশ্রণ |
ডঃ এ. পি. জে. আবদুল কালামের জীবন আমাদের শেখায়, জাতি, ধর্ম, আর্থিক অবস্থা কোনও কিছুই একজন মানুষকে থামাতে পারে না, যদি তাঁর মধ্যে থাকে স্বপ্ন, শিক্ষা, এবং নিষ্ঠা। তাঁর জীবন কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক অনন্য শিক্ষার উৎস।
তাঁর উক্তি—
“Let us sacrifice our today so that our children can have a better tomorrow.”
আজও কোটি কোটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
তাঁর জীবন, কর্ম ও চিন্তা আমাদের শেখায় কীভাবে আমরা নিজেদের উন্নত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।