
হিরামন মন্ডল সাগর, বটিয়াঘাটা খুলনা :
বটিয়াঘাটায় মুজিব শতবর্ষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।ঘর নির্মাণে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার, ঘর বিক্রি, ভাড়া দেওয়া, প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে প্রকল্পটি শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।সরকারি নথি অনুযায়ী,বটিয়াঘাটার ৭টি ইউনিয়নে বিভিন্ন ধাপে মোট ৭৪৬ টি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।এসব ঘর নির্মাণে খরচ বাবদ মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ১৯ কোটি ৪ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে (২০২০ – ২১) অর্থবছরে ১৫০ টি ঘর নির্মাণ করা হয়। যার খরচ ধরা হয় ২ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই অর্থবছর গৃহ নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত পরিবহন ও জ্বালানি খরচ বাবদ বরাদ্দ হয় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে (২০২০ – ২১) অর্থবছরে ৩০ টি ঘর নির্মাণ করা হয়। যার খরচ ধরা হয় ৫৭ লাখ টাকা। অতিরিক্ত পরিবহন ও জ্বালানি খরচ বাবদ বরাদ্দ হয় ১লাখ ৬০ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ের ১ম ধাপে (২০২১-২২) অর্থবছরে বরাদ্দ হয় ১০০ টি ঘর।। যার নির্মাণ বাবদ খরচ ধরা হয় ২ কোটি ৪৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে ২য় ধাপে (২০২১-২২) অর্থবছরে ঘর বরাদ্দ হয় ৩০ টি। যার গৃহ নির্মাণ বাবদ খরচ ধরা হয় ৭৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে ( ২০২১/২২) অর্থবছরের প্রথম ধাপে গৃহ নির্মাণ বাবদ অতিরিক্ত বাজার মূল্যে বরাদ্দ হয় ১০০টি ঘর। যার খরচ ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে ( ২০২১/২২) অর্থবছরের ২য় ধাপে ১০০ টি ঘরের জন্য গৃহ নির্মাণ বাবদ খরচ ধরা হয় ২ কোটি ৬৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। চতুর্থ পর্যায় (২০২২ -২৩) অর্থবছরে প্রথম ধাপে বরাদ্দ হয় ৮০টি ঘর। যার খরচ ধরা হয় ২ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০২২ -২৩ অর্থবছরে চতুর্থ পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে বরাদ্দ হয় ২৫০টি ঘর। যার খরচ ধরা হয় ৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০২৩ -২৪ অর্থবছরে পঞ্চম পর্যায় বরাদ্দ হয় ৬টি ঘর। যার ঘর নির্মাণ খরচ ধরা হয় ১৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গৃহ নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত পরিবহন ও জ্বালানি বাবদ ৬টি ঘরের জন্য বরাদ্দ হয় ৩১ হাজার ২০০ টাকা। বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণ ঘর নির্মাণের নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির দৃশ্য। অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা। তথ্য অনুসন্ধানে যানা যায়, কাগজে কলমে ঘর নির্মাণের যে খরচ দেখানো হয়েছে, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুফল ভোগীদের অভিযোগ, প্রতিটা ঘর বাবদ দেড় লাখ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটা ঘর নির্মাণে খরচ হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রকল্পে ঘর নির্মাণে যেসব মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। যেমন টিনের ঘরের কাঠ, সিমেন্ট, ইট, বালু, রড, এমনকি ঘরের সকল মালামাল দেওয়া হয় অত্যন্ত নিম্নমানের। অনেকে অভিযোগ করেন, ঘর নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে অধিকাংশ ঘর ভেঙ্গে পড়ে। আবার বছর না যেতেই শুরু হয় ঘর বিক্রির হিড়িক। অনেকে ঘর বিক্রির অভিযোগে জেলও খেটেছে, এমন অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা জানান, ঘর গুলো নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নমানের ইট, বালু, সিমেন্ট ও কাঠ।
ফলে অনেক ঘর নির্মাণের অল্পদিনের মধ্যে দেয়াল ফেটে ভেঙ্গে পড়া, মেজে ধসে যাওয়া, বৃষ্টির পানি ঢুকে ঘর অচল হয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আবার অনেক ঘর পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। রেবেকা, রথীন, মহসিন, কুদ্দুস সহ আরো অনেকে বলেন, ঝড় বৃষ্টি হলে আমরা ঘরে থাকার সাহস পাই না। যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে, এই ভয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, ঘর বিক্রি ও ভাড়া দেওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে। সুরখালী ইউনিয়নের রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি মহসিন সানা বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১৫০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ঘরের মধ্য থেকে বহু ঘর অযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা এখন জীবন মরণের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি আরো বলেন,ঘটনাটি স্বচ্ছ তদন্ত পূর্বক সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা এবং ভেঙ্গে পড়া ঘর গুলোর জরুরী পূর্ণনির্মাণের আহবান জানান তিনি। এছাড়াও টাকার বিনিময়ে এখানে ঘর বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ভূমিহীন গৃহহীন মানুষের পূর্ণবাসন। কিন্তু বাস্তবে কিছু উপকারভোগী মোটা অংকের টাকার বিনিময় ঘর বিক্রি করে বা ভাড়া দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা এসিল্যান্ড অফিসের কিছু অসাধু কানুনগো, সার্ভেয়ার ও স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি এসব লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে তথ্য অনুসন্ধানে গিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিষয়ে চরম হয়রানির শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। কেউ বলেন, এটা আমি জানিনা, ওটা উনি জানেন। আবার কেউ বলেন ঘটনাটি অনেক আগের। তখন আমি এখানে ছিলাম না। যারা ছিল, তারা অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছে। ইউএনও কার্যালয়ে থেকে বরাদ্দের আংশিক তথ্য মিললেও সার্বিক তথ্য দিতে তারা অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এসিল্যান্ড অফিসে গেলে একই ধরনের তালবাহানা। অনেকে বলেন, কর্তারা বদলি হয়ে গেছেন। ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে। অন্যদিকে উপজেলার জলমা, বালিয়াডাঙ্গা ও সুরখালী ইউনিয়নের একাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও ঘর কেনাবেচার অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি সরকারি ভাবে গৃহহীন মানুষের জন্য নির্মিত এসব ঘর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে কেনা বিক্রির মাধ্যমে হাতবদল হয়েছে। জলমা ইউনিয়নের তেঁতুলতলা দশগেট এলাকায় ১৬০টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০-৪০টি ঘর বিক্রির অভিযোগ উঠেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক স্থানীয় সূত্র। ঘর নং ১০০-এর মালিক জেসমিন আক্তার তার ঘরটি স্থানীয় মো. শামীমের কাছে বিক্রি করেন।ঘর নং ৯৯-এর একজন মালিক ঘরটি বিক্রি করেন একই এলাকার মাহাতাব হোসেনের কাছে।এ ছাড়া আরও নয়জনের কাছে ঘর বিক্রির অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে ঘর কিনে ঘর না পাওয়ায় ওই নয়জনের পক্ষে নতুন বাজার এলাকার মিরাজ শিকদার বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন।মামলায় বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুজন, এবং ঘর কেনাবেচার সাথে জড়িত বহিরাগত জুলেখা ও সাইফুল নামের দু’জনকে আসামি করা হয়। পরে জুলেখা ও সাইফুলকে আটক করা হলেও সুজনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে বলে জানা যায়। মাথাভাঙ্গা এলাকায়ও একই অভিযোগ উঠেছে। মাথাভাঙ্গা এলাকার ২০০টি ঘরের মধ্যে ২০-২৫টি ঘর বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এখানেও একইভাবে ঘর হাতবদলের অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নে বালিয়াডাঙ্গার বিরাট এলাকায়ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বিক্রির একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোজাফফর মল্লিক তার ঘর বিক্রি করেন মফিজের স্ত্রীর কাছে।বিলকিস বেগম ঘর বিক্রি করেন আসলামের কাছে।নুর ইসলাম ঘর বিক্রি করেন আমানাত মাঝির কাছে।মুরছানিল ঘর বিক্রি করেন রিসালের কাছে।
হায়দার আলী তার ঘর বিক্রি করেন স্থানীয় হ্যাপি বেগমের কাছে।এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন ঘর বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করেন। ঘর ক্রয়কারী মাহাতাব হোসেন বলেন, টাকার বিনিময়ে আমি ঘরটি কিনেছি। এখনো আমার নামে কোনো কাগজপত্র হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিক সোহরাব হোসেন মুন্সী বলেন, অনিয়ম দুর্নীতির কথা আর কী বলবো? সরকারের টাকা যে হরিলুট হয়েছে এটা স্পষ্ট। রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের এক ব্যাবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, মুজিব বর্ষের ঘর অনেকের নিকট স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন সেটা দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬নং বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো : আবু বকর মোল্লা বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি ও ঘর কেনাবেচার কোন বিষয় আমার নিকট কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলেই তদন্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বটিয়াঘাটা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: শোয়েব শাত-ঈল-ইভান বলেন, ঘর নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়টি তার যোগদানের আগেই সম্পন্ন হওয়ায় এ বিষয় বিস্তারিত মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তিনি জানান,ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ হলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। সরকারি ঘর যদি কেনাবেচা হয়ে থাকে,তাহলে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থান্দার কামরুজ্জামান জানান, আমি সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করায় ঘটনাটির পুরো বিবরণ আমার জানা নেই। তিনি বলেন, তদন্তের মাধ্যমে সবকিছু যাচাই করা হবে। অনিয়ম প্রমাণ মিললে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।















