
নিউজ ডেস্ক
চীন এবং বাংলাদেশ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী ও গভীর করার জন্য একমত হয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিতে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নবযাত্রা
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, হাইনানের উপকূলীয় শহর বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াং বৈঠক করেন। এ বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের আন্তরিক সহযোগিতা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তার ওপর আলোচনা হয়।
ডিং শুয়েশিয়াং বলেন, “প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আপনার সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছেন। চীন আশা করে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি অর্জন করবে।”
বাংলাদেশের ওয়ান-চায়না নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওয়ান-চায়না নীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেওয়া প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশ হিসেবে ঢাকা গর্ব অনুভব করে।”
এ সময় বাংলাদেশ চীনা ঋণের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি, চীনের সহায়তায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে আরও সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশ চায়, চীনা ঋণের সুদের হার ৩ শতাংশ থেকে ১-২ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক, এবং চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কমিটমেন্ট ফি মওকুফ করা হোক।
বাংলাদেশে শিল্প স্থানান্তরে চীনের সহায়তা
বাংলাদেশ চায়, চীনা তৈরি পোশাক কারখানা, বৈদ্যুতিক যানবাহন, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক্স, চিপ উৎপাদন এবং সৌর প্যানেল শিল্পগুলি বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হোক। চীনের সহযোগিতায় এসব শিল্পের স্থানান্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার
চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াং জানান, “২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।” এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, কারণ দেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এই সুবিধা বহাল থাকবে।
মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা ও নতুন প্রকল্পসমূহ
চীন বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা শুরু করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। এছাড়া, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন এবং দাশেরকান্দি পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের উন্নয়নে চীন অর্থায়ন করবে।
চীন সম্প্রতি বাংলাদেশের আম রপ্তানি নিয়ে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষর করেছে এবং এ বছর গ্রীষ্মকাল থেকেই বাংলাদেশ থেকে চীনে আম রপ্তানি শুরু হবে। চীনের আগ্রহ রয়েছে কাঁঠাল, পেয়ারা এবং অন্যান্য জলজ পণ্য আমদানি করার জন্য, যাতে উভয় দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশ-চীন শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রসার
উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াং বলেন, “চীনা সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি স্কলারশিপ দেবে।” ইতোমধ্যেই হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ভূমিকা
চীন বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সংলাপ আয়োজন করতে আগ্রহী। চীনের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিতে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের শিপিং খাতে উন্নয়ন
উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াং ঢাকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনার ক্ষেত্রে চীনের অর্থায়নের আশ্বাস দেন।
অধ্যাপক ইউনূসের কৃতজ্ঞতা
অধ্যাপক ইউনূস চীনের নেতৃত্বের সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আজকের এই বৈঠক বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের এক নতুন মাইলফলক।” তিনি দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং একটি নতুন যুগের সূচনা করার আহ্বান জানান।
উপস্থিত অতিথিরা
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান এবং বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
উপসংহার
চীন এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে পৌঁছেছে। চীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আরও শক্তিশালী সহযোগিতার পথ খুলে দেবে।