বিশেষ প্রতিনিধি :
গত ৪ জুলাই সকালে নগরীর হরিণটানা থানার রায়েরমহল আন্দিরঘাট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে একটি আবাসিক প্রকল্পের কাশবন থেকে পুলিশ এক অজ্ঞাত নারীর মরদেহ উদ্ধার করে। পরবর্তীতে হরিণটানা থানা পুলিশ অজ্ঞাত নারীর পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং জানা যায় যে, মৃত নারী শামীমা আক্তার। বয়স ১৮ বছর। নিহত গৃহবধূ রায়েরমহল এলাকার বাসিন্দা মোঃ সাইদুর রহমানের স্ত্রী। ওই ঘটনায় ভিকটিমের পিতা বাবুল সানা নিহত শামীমা আক্তারের স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানসহ অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনের বিরুদ্ধে হরিণটানা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
শনিবার কেএমপি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পারিবারিক অশান্তির জের স্বামী এবং তার দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণের পর স্ত্রীকে হত্যা করে। চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে কেএমপি’র হরিণটানা থানা পুলিশ। প্রধান আসামিসহ গ্রেফতার হয়েছে ৩ জন। আদালতে স্বামী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে।
কেএমপি সূত্র জানায়, খুলনা জেলার কয়রা অঞ্চলের আইলা এবং সিডর বিধ্বস্ত এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য বাবুল সানা। অভাবের তাড়নায় হতদরিদ্র অবস্থায় ছেলে এবং মেয়ের হাত ধরে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে খুলনা মহানগরীর হরিণটানা থানার রায়েরমহল এলাকায় এসে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। শুধুমাত্র সংসারের অভাবের কারণে সন্তান দু’টির মুখে দুই বেলা দুইমুঠো ভাত তুলে দিতে না পেরে শিক্ষা বঞ্চিত অবস্থায় তার কন্য শামিমা আক্তারকে সাইদুর রহমান নামক একজন পাষন্ডের নিকট বিবাহ দেন পিতা বাবুল সানা। কিন্তু মাত্র ৫ মাসের দাম্পত্য জীবনের ব্যবধানে পাষন্ড সাইদুরের হাতে নির্মমভাবে খুন এবং ধর্ষণের শিকার হয় শামিমা আক্তার।
সূত্রটি জানায়, পারিবারিক কলহের জেরে মেয়ের উপর স্বামীর উপর্যুপরি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবুল সানা মেয়েকে নিয়ে আসেন তার বসত বাড়িতে। এ বিষয়ে বাবুল সানার পরিবারের সঙ্গে শামীমার স্বামী সাইদুর রহমানের পরিবারের বাকবিতন্ডা হয়। যার ফলে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ রাগ ঘৃণা এবং প্রতিশোধের আগুন জন্মাতে থাকে সাইদুরের মনে। সাইদুর পূর্ব থেকেই নেশাগ্রস্ত ছিলো। সে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সাথে নিয়ে প্রতিশোধের পরিকল্পনা আটতে থাকে। যার প্রেক্ষিতে গত ৪ জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সহযোগী সোহাগকে নিয়ে সে হাজির হয় বাবুল সানার বসত বাড়িতে। কৌশলে নিজের অভিনয়কে কাজে লাগিয়ে শামিমা আক্তারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে সামান্য একটি মোবাইল ফোন এবং একটি বোরকা কিনে দেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। শামিমার কোমলমতি মন স্বামীর এহেন কথায় গলে যায়। সে তাকে বিশ্বাস করে, ক্ষমা করে এবং অভাবের কাছে হার মেনে মোবাইল ফোন এবং বোরকা পাওয়ার আশায় নতুন করে সংসার সাজিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে স্বামীর হাত ধরে বয়রা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হরিণটানা থানাধীন আন্দিরঘাট ব্রিজের নিকট ভ্যান থামিয়ে পার্শ্ববর্তী কাশবনের জঙ্গলে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক তার উপর হামলে পড়ে সাইদুর রহমান। সে শামীমাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক মেলামেশায় বাধ্য করে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় সাইদুরের সহযোগী সোহাগ এবং তপু। তারাও পাষন্ড স্বামী সাইদুরের সম্মতিতে ভিকটিম শামীমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এরপর সহযোগী সোহাগ চেপে ধরে শামিমার দুই পা, আর তপু চেপে ধরে শামিমার দুই হাত। আর সাইদুর নেশাগ্রস্ত চেপে ধরে শামিমার গলা। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই মারা যায় শামিমা। ঘটনার পর থেকে আসামিগণ পলাতক ছিল।
এই ঘটনায় কেএমপি’র পুলিশ কমিশনার বিশেষ নির্দেশনায় মামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেফতারের জন্য হরিণটানা থানায় একটি চৌকস তদন্ত টিম প্রস্তুত করা হয়। গত জুলাই মাস থেকে নিরলসভাবে কাজ করেও হরিণটানা থানা পুলিশ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হচ্ছিল না। দীর্ঘ ৩ মাস ধরে নিরলস প্রচেষ্টার পর হরিণটানা থানা পুলিশ অবশেষে গত ২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে আড়ংঘাটা থানার শলুয়া বাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর শামীমা হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামি নিহত ভিকটিমের স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানকে (২১) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
শনিবার রায়েরমহলে গৃহবধূ শামীমা আক্তার (১৮) হত্যা মামলার প্রধান আসামি তার স্বামী মোঃ সাইদুর রহমানকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
আসামি মোঃ সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারপূর্বক তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক রায়েরমহল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তার বন্ধু রায়ের মহল মন্দিরের মোড় এলাকার জামাল মোলার ছেলে মোঃ সোহাগ মোলা (২০) এবং রায়ের মহল পশ্চিমপাড়ার মোঃ মকিতুর রহমানের ছেলে মোঃ শরিফুল ইসলাম তপুকে (২৬) গ্রেফতার করা হয়। সোহাগ মোলা ও শরিফুল ইসলাম তপুকে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে আসামিদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বাকী দুই আসামিকেও পুলিশ রিমান্ডে এনে ঘটনা সংক্রান্তে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।